সম্প্রীতির প্রবারণায় আলোকিত ফানুসের আলোয় আলোকিত হোক পৃথিবী


অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশের সময় : অক্টোবর ৮, ২০২২ । ১১:০৫ অপরাহ্ণ
সম্প্রীতির প্রবারণায় আলোকিত ফানুসের আলোয় আলোকিত হোক পৃথিবী

উৎফল বড়ুয়া :

প্রবারণা: প্রবারণা বৌদ্ধ ধর্মীয় অনুশাসনের অন্যতম এক ধর্মীয় উৎসব। আত্নন্বেষণ ও আত্ন সমপর্ণ এর তিথি। এটি গৌতম বুদ্ধ তাঁর ভিক্ষু সংঘের জন্য প্রবারণা অনুজ্ঞা প্রদান করেছিলেন-ভিক্ষু তিন মাস বর্ষাবাস ব্রত পালনোত্তর আসে প্রবারণা।

বর্ষাবাসব্রত পালন কালে ভিক্ষুসংঘ সদ্ধর্মাচারের গভীর ভাবে অনুধ্যান ও অনুবেদনে ব্যাপৃত থাকেন, তাই প্রতিটি বিহারে ভিক্ষুসংঘ পরস্পরের সাথে বাস করেও বর্ষাবাস কালীন প্রায় একাচারী জীবন যাপন করেন। কারণ এ সময় বর্ষাব্রতের শৃংখলা রক্ষার্থে ভিক্ষুসংঘ পরস্পরের সাথে আলাপচারিতা বর্জন করতেন গৌতম বুদ্ধ এরূপ নিস্পাণ মৌনব্রত অবিধেয় বলেছেন।

গৌতম বুদ্ধ শ্রাবস্তীতে অনাথপিন্ড শ্রেষ্ঠীর আরামে অবস্থানকালে কৌশল জনপদে বর্ষাবাস যাপনকৃত ভিক্ষুসংঘের জীবনাচার বিধি অবগত হয়ে বুদ্ধ বর্ষাবাস তিনমাস বর্ষাবাসব্রত পালনোত্তর প্রবারণা পালনের সূচনা হয়। যা আজও যথাযথ শ্রদ্ধা,ধর্মীয় মর্য়াদায় ও আন্তরিক অনুশীলনের মাধ্যমে ভিক্ষুসংঘের ধর্মাচারের ধারায় গুরুত্বের সাথে পালিত হচ্ছে।

প্রবারণার অর্থ: প্রবারণার শাব্দিক অর্থ প্রকৃষ্ট রূপে বারণ বা নিষেধকরণ। সেই নিষেধযোগ্য বিষয় সমূহ হলো-আচরণীয় ক্ষেত্রে ত্রুটি নৈতিক স্থলন এবং সর্বোপরি চিত্তের মল(লোভ,বিদ্বেষ ও মোহ)এগুলোর নিরোধমূলক অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকলে এগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকা যায়।

 

প্রকৃত অর্থে এগুলোই হলো(লোভ,বিদ্বেষ ও মোহ) মানুষের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে মূল অন্তরায়। এই অন্তরায় হতে দুরে থাকার জন্য চঞ্চল চিত্তের জন্য দরকার পরিশুদ্ধ অবলম্বন। তাই ‘প্রবারণার’ আর একটি অর্থ হলো ‘বরণ’ অর্থাৎ শুভ, শুদ্ধ, সুন্দর ও সু-আচারকে বরণ। বৌদ্ধ পরিভাষায় বলা যায় অকুশলকে বারণ এবং কুশলকে বরণই হলো প্রবারণা। বলাবাহুল্য শুধু কৃতকর্মের জন্যই প্রবারণা নয়।

 

গৌতম বুদ্ধের অনুজ্ঞা মতে চিত্তের অন্তলীন কমনা-বাসনা অথবা অনুমেয় ও আশন্কিত মনোবাসনার জন্যও প্রবারণা আবশ্যক। ত্রিপিটকের মহাবর্গ গন্থে দেখা যায় বুদ্ধ ভিক্ষুদের বলেছেন-“ভিক্ষুগণ দৃষ্টশ্রুত অথবা আশান্কিত ত্রুটি বিষয়ে প্রবারণা করিবে”।
প্রবারণার আর একটি বিশেষ গুণ হলো-এর মাধ্যমে সাংঘিক জীবনের পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীলতা, অপরাধ প্রবণতা দূরীকরণ এবং বিনয়আনুবর্তিতা সুদৃর করণে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।

 

সে দিক থেকে প্রবারণার সরলীকৃত স্বরূপ হলো “আত্নশুদ্ধি ও উৎসব”। ভিক্ষু সংঘ এই তিথিতে পরস্পরের কাছে স্ব-স্ব দৃষ্টশ্রুত অথবা আশন্কিত অপরাধ প্রসঙ্গে মাজর্না কামনা করেন এবং জ্ঞাতসারে যদি কোন অপরাধ ঘটে যায় তার জন্য বিনয় সন্মত প্রতিবিধান প্রদানের কাজটিও প্রবারণায় হয়। সুতরাং মহান ভিক্ষুসংঘের জীবনে প্রবারণার গুরুত্ব অপরিসীম।
প্রবারণার ফানুস সংস্কৃতিঃ প্রবারণা পূর্ণিমার উৎসবে কখন থেকে কীভাবে যে ফানুস উৎসবের সংযোগ হেছে তা সঠিকভাবে বলা দুস্কর। শাস্ত্রে ফানুসের বৃত্তান্ত বিশেষভাবে দৃষ্টও হয় না।

 

নির্দিষ্ট কোন অনুষ্ঠানে বুদ্ধের সময়ে ফানুস উৎসবের আয়োজন হতো এরকম কোন ইঙ্গিত মেলে না। এ প্রসঙ্গে অনেকের সাথে কথা বলে নানা বিষয় সম্পর্কে
আমি অবগত হয়েছি। যে তত্ত্ব বা তথ্য সমূহকে এক কথায় বলা যায় এ যুগের ভাবনা। যেমন অনেকের মতে বুদ্ধের সময়ে কাগজের ব্যবহার ছিল কি না ? এরূপ সংশয়ও আছে।

 

কিন্তু জাতকে দেখা যায় সে সময় কাগজের ব্যবহার,চিত্র শিল্পের ব্যবহার ইত্যাদি ছিল। হয়ত আজকাল ফানুষ তৈরিতে যে মসৃন পাতলা কাগজ ব্যবহৃত হয় তা ছিল না। এছাড়া ফানুসের কথা কোথাও সরাসরি উল্লেখ নেই। জাতকে কার্তিকোৎসবের কথা দেখা যায় যা কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথিতে অনুষ্ঠিত হতো। এ উৎসব দু’তিন দিন স্থায়ী হওয়ার তথ্যও পাওয়া যায়। এ প্রেক্ষিতে এটিই অনুমিত হয় যে, সে সময় যেহেতু কঠিন চীবর দানোৎব(যা প্রবারণার পর হতে শুরু হয়) এত জাঁকজমক করে আয়োজন হতো না।

 

এছাড়া বর্ষাবাস বর্ধিত করায় এবং আষাঢ়ী পূর্ণিমায় বর্ষাবাস ব্রত শুরু করতে না পারলে শ্রাবণী পূর্ণিমায় শুরু করার বিধান রয়েছে । সে হিসাবে বর্ষাবাস সমাপনোত্তর এটি কার্তিক উৎসব বলে ধরা হয়। এখানে বহুমাএিক ধর্মীয় ও আনন্দ উৎসবের আয়োজন হতো। হয়ত তারই ধারাবাহিকতায় আজকের প্রবারণা পূ্ণিমায় বহুবিধ সামাজিক আনন্দ উৎসবের সংযোজন। যার ফানুস উত্তোলন একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় ।

 

কিন্তু শাস্এীয় বিশেজ্ঞদের মধ্যে অনেকে এ বিষয়ে আবার অন্যমতও পোষণ করেন। যা বৌদ্ধরা অনাদিকাল হতে শ্রুতি পরস্পরায় নিজেদের অন্তরে জাগরুক করে রেখে ফানুসের প্রজ্জ্বলিত আলোক ধারায় আকাশস্থিত গৌতম বুদ্ধের চুলগুচ্ছকে বন্দনা জ্ঞাপন। এই চৈতন্যের আলোকেই অত্যন্ত শ্রদ্ধাচিত্তে প্রবারণা পূর্ণিমায় ফানুস উত্তোল সংস্কৃতিতে লালন করে চলেছে। ফানুস বৌদ্ধ সংস্কৃতির একটি অনন্য সংযোজন।

 

এটি আজ শুধু ধমীর্য় বিষয় নয় অন্যতম একটি সামাজিক উৎসব। ফানুস উৎসব উপভোগ করার জন্য জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রবারণা পূর্ণিমায় বৌদ্ধ বিহার গুলোতে সমবেত হয়। তাই ঐতিহ্য ও ইতিহাসের অন্যতম বিষয় হিসেবে এই ফানুস উৎসবকে যথাযথ মযার্দায় সজীব রাখা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য । এই ফানুস উৎসবের জন্য প্রবারণা পূর্ণিমার সামাজিক অধ্যায় বা প্রভাব বহুলাংশে সর্বজনীনতা লাভ করেছে ।

 

প্রবারণা উৎসবের দিন সমাপনোত্তর ফানুস(আকাশ প্রদীপ) উড়িয়ে বৌদ্ধরা বিশ্বের সকলের সুখ,শান্তি ও সকল অন্ধকারকে প্রশ্চাতপদ করে আলোকিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিশ্বময় করার আর একটি প্রয়াসও বটে ।

সম্প্রীতির প্রবারণায় আলোকিত ফানুসের আলোয়  আলোকিত হোক পৃথিবী, দূর হোক পৃথিবীর সমস্ত অন্ধকাার। বিশ্বে শান্তি আসুক, চেতনা হোক প্রজ্ঞায় উদ্ভাসিত।
লেখকঃ উৎফল বড়ুয়া, সভাপতি, বাংলাদেশ বৌদ্ধ যুব পরিষদ, সিলেট অঞ্চল, সংগঠক ও মানবাধীকার কর্মী।

পুরোনো সংখ্যা

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩১৪১৫১৬
১৭১৮১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭২৮২৯৩০
৩১  
%d bloggers like this: