সর্বশেষ :

বরিশালের শিক্ষার বাতিঘর: ১৩৬ বছরের ব্রজমোহন কলেজ


অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশের সময় : নভেম্বর ২৬, ২০২৫ । ৯:০৫ পূর্বাহ্ণ
বরিশালের শিক্ষার বাতিঘর: ১৩৬ বছরের ব্রজমোহন কলেজ

মারিয়া আক্তার লিজা: বরিশাল শহরের হৃদমাঝে দাঁড়িয়ে আছে এক সুদীর্ঘ ইতিহাস বয়ে আনা বিদ্যাপীঠ—ব্রজমোহন কলেজ। কেউ বলে এটি প্রতিষ্ঠান নয়, বরং দক্ষিণ বাংলার প্রজ্ঞার উৎস; কেউ বলে এটি এক গভীর আলোর শিখা, যার ছায়ায় দাঁড়িয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম নিজেদের পথ খুঁজে নিয়েছে। ১৩৬ বছরের সেই আলো আজও নিভে যায়নি, বরং নতুন স্বপ্ন, নতুন দৃষ্টি আর আধুনিকতার স্পর্শে আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

১৮৮৯ সালে অশ্বিনীকুমার দত্তের হাত ধরে যাত্রা শুরু হয়েছিল ব্রজমোহন কলেজ—যে মানুষটি বিশ্বাস করতেন, “শিক্ষাই মানুষকে মুক্তি দেয়, আর শিক্ষিত প্রজন্মই সমাজকে বদলে দেয়।” তখন এটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত। উচ্চমানসম্পন্ন শিক্ষা, দৃষ্টিভঙ্গির বিস্তার ও সংস্কৃতির চর্চা—এই সবকিছুর কারণে বহুদিন ধরেই ব্রজমোহন কলেজ নন্দনতত্ত্ব ও জ্ঞানচর্চার এক অনন্য অঙ্গন হিসেবে পরিচিত। দক্ষিণ বাংলার মানুষ তখনই এটিকে তুলনা করেছিল ‘দক্ষিণ বাংলার অক্সফোর্ড’—একটি উপাধি যা এখনো তার গৌরবকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

১৯৬৫ সালে কলেজটি জাতীয়করণ হয়। বর্তমানে এটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হলেও তার নিজস্ব ঐতিহ্য, চরিত্র এবং শিক্ষা-দর্শন আগের মতোই দীপ্তিমান।

হোস্টেল জীবন: ইতিহাস আর বৈচিত্র্যের অভিজ্ঞান

কলেজটির আবাসিক পরিবেশও সমান সমৃদ্ধ। চারটি ছাত্র হোস্টেল—ফজলুল হক হল, মহাত্মা অশ্বিনী কুমার হোস্টেল, কবি জীবনানন্দ দাশ হোস্টেল ও সুরেন্দ্র ভবন ছাত্রাবাস—এখানে শুধু থাকার জায়গা নয়, বরং ছাত্রজীবনের স্মৃতি তৈরি হওয়ার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
মেয়েদের তিনটি ছাত্রী নিবাসের মধ্যে বর্তমানে শুধুমাত্র বনমালী গাঙ্গুলি ছাত্রী নিবাস চালু আছে—যা নিরাপদ, সাংস্কৃতিক চর্চায় সমৃদ্ধ এবং স্বপ্নবান মেয়েদের প্রতিদিনের গল্পে ভরপুর।

যেখানে পাঠের পাশাপাশি গড়ে ওঠে মানুষ

৪০,০০০ বইয়ের সমৃদ্ধ লাইব্রেরি, আধুনিক বিজ্ঞান ভবন, বাণিজ্য ভবন, কলা ভবন, প্রশাসনিক দফতর, পরীক্ষা ভবন, বিশাল অডিটোরিয়াম, বাকসু ভবন—সব মিলিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানকেন্দ্র।
এ ছাড়া রয়েছে কেন্দ্রীয় মসজিদ, আরও দুটি ক্ষুদ্র মসজিদ ও একটি মন্দির—যা প্রমাণ করে এই প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় সহাবস্থান কেবল শব্দ নয়, বরং চর্চা।

ক্যাম্পাসের দুই প্রান্তের মাঠ আর মাঝের দিঘি যেন এই শিক্ষাপীঠের প্রাণ। সকালবেলার কুয়াশার পর্দা সরিয়ে যখন প্রথম সূর্যের আলো দিঘির পানিতে ঝিকিমিকি করে, তখন মনে হয় ব্রজমোহন কলেজ একটু বেশি জীবন্ত, একটু বেশি আপন।

সংস্কৃতি, সৃজনশীলতা ও নেতৃত্বের অঙ্গন

শুধু পড়ালেখাই নয়—এখানে আছে ক্যাম্পাসজুড়ে সংস্কৃতি, বিতর্ক, সংগঠন, নেতৃত্ব ও মানবসেবার অনন্য আয়োজন।
ডিবেটিং ক্লাব, ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ ক্লাব, বাঁধন, রোভার স্কাউটস, বিএনসিসি—সবই শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিত্ব, দক্ষতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

ক্যাম্পাসে রয়েছে ‘ক্যাফে জীবনানন্দ’। কবি জীবনানন্দ দাশের নামে নির্মিত এই ক্যাফে আজ তার সাহিত্যচেতনা, স্বপ্নবাজি এবং নীরব সৌন্দর্যের প্রতীক। এখানে বসে শিক্ষার্থীরা শুধু চা-কফি পান করে না; বরং তৈরি করে নতুন গল্প, নতুন ধারণা, নতুন আগামীর পথ।

শিক্ষার আলো ছড়িয়ে বদলে দিয়েছে পুরো অঞ্চলকে

শত বছরের বেশি সময় ধরে ব্রজমোহন কলেজ বরিশালকে শুধু শিক্ষায় সমৃদ্ধ করেনি; পরিবর্তন করেছে সংস্কৃতি, সমাজ ও রাজনৈতিক সচেতনতা। এখানকার অসংখ্য শিক্ষার্থী দেশের উঁচু পদে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে, সমাজে সেবা করছে এবং মানবিক মূল্যবোধ ছড়িয়ে যাচ্ছে সর্বত্র।

আজও ব্রজমোহন কলেজ—
একটি প্রতিষ্ঠান নয়,
একটি ঐতিহ্য।
একটি স্মৃতি।
একটি আলো।

যে আলো বরিশালের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মানবিকতায় চিরকাল দীপ্ত থাকবে।

সার্থকভাবেই তাই বলা হয়—
“বরিশালের শিক্ষার বাতিঘর—ব্রজমোহন কলেজ।”

পুরোনো সংখ্যা

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩১৪১৫১৬
১৭১৮১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭২৮২৯৩০
%d bloggers like this: