মোঃ মানিক হোসেন, রাজশাহী (বিভাগীয়) প্রতিনিধি :
রাজশাহীতে সিআরপির পরিচিতি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসময় রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র কণ্যা ডা: আনিকা ফারিহা জামান অর্ণা প্যারালাইজড, পঙ্গু, প্রতিবন্ধীদের কথা বলার সময় আবেগে আপ্লূত হয়ে কান্না করেন।
তাঁদের প্রতি সমাজের মানুষদের বৈষম্যমূলক আচরণ বা অবহেলা ও কটুক্তিমূলক ব্যবহার কতটা নির্মম ও কষ্টদায়ক তা তুলে ধরে বক্তব্যের এক সময় পরিচিত সভা নিস্তব্ধ হয়ে যায় ছোট বাচ্চাদের মত মেয়র কন্যার কান্না দেখে। সেই সাথে উপস্থিত প্রায় সবাই কান্না করে ফেলেন।
বৃহস্পতিবার (৯ ফেব্রুয়ারি) জেলার কাটাখালি পৌরসভার কাপাসিয়া বাজারের পাশে এই পরিচিতি সভা অনুষ্ঠিত হয়।
জানা গেছে, সিআরপির এই সেন্টারের নাম মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের বাবা ও মায়ের নামে উৎসর্গ করা হয়েছে। নাম রাখা হয়েছে পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন বিভাগীয় উপকেন্দ্র শহীদ এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও জাহানারা জামান সেন্টার নামে। আর্তমানবতার সেবায় জনকল্যাণে সিআরপি‘কে পারিবারিক ১৫ বিঘা জমি দান করেছেন জাতীয় চার নেতার অন্যতম শহীদ এ.এইচ.এম কামারুজ্জামানের হেনার পুত্র বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এ.এইচ.এম খায়রুজ্জামান লিটন।
এখানে রাজশাহীর পার্শ্ববর্তী এলাকা নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, বগুড়া, রংপুর পর্যন্ত, খুলনা পর্যন্ত অনেক মানুষ আছে যাদের চিকিৎসা সেবার খুবই কষ্ট তারা আসবেন, সেবা নিবেন এবং সুস্থ হবেন। চিকিৎসা সেবাসহ এই প্রতিষ্ঠানটিকে ঘিরে কর্মসংস্থান শুরু হবে বলে আশা ব্যক্ত করেছেন রাসিক মেয়র, কণ্যা ও স্ত্রী।
সিআরপি-রাজশাহী শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান ও জাহানারা জামান সেন্টারে যেসব চিকিৎসা সেবাসমূহ পাওয়া যাবে, সেগুলো হচ্ছে, অপারেশন সেবা। প্যাথলজি ও রেডিওলজি সেবা। অভ্যন্তরীণ সেবার মধ্যে থাকবে মেরুরজ্জুতে আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের জন্য একটি পুনবার্সন কেন্দ্র, অটিজম ও সেরিব্রাল পালসি আক্রান্ত শিশুদের জন্য বিশেষায়িত শিশুবিভাগ, স্ট্রোক রোগীদের জন্য পুনর্বাসন ওয়ার্ড, মেডিকেল কনসালটেন্সি, অকুপেশনাল থেরাপি, স্পীচ এন্ড ল্যাঙ্গুরেজ থেরাপি, শিশু বিভাগ, ক্লাব ফুট বা মুগুর পা চিকিৎসা, মানসিক স্বাস্থ্য সেবায় ডে কেয়ার সেন্টার। পুনর্বাসন সেবাসমূহের মধ্যে থাকবে আর্থ-সামাজিক সহায়তা, সমাজভিত্তিক পুনর্বাসন, মনো-সামাজিক কাউন্সিলিং, ক্রীড়া ও বিনোদন। আর সহায়ক ও পুনর্বাসন সামগ্রীর মধ্যে থাকবে প্রস্থেটিক্স এবং অর্র্থোটিক্স (কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজন), অর্থোপেডিক সু টেকনোলজি, সাপোর্টিভ সিটিং বিভাগ, হুইলচেয়ার ও অন্যান্য সহায়ক সামগ্রী।
এছাড়াও এখানে গড়ে তোলা হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এখানে রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১ বছরের ইন্টার্নশিপ সহ ৪ বছর মেয়াদি বিএসসি ইন ফিজিওথেরাপি, বিএসসি ইন অকুপেশনাল থেরাপি, বিএসসি ইন স্পীচ এন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি কোর্স করতে পারবেন শিক্ষার্থীরা।
অবকাঠামো সুবিধার মধ্যে থাকবে মেরুরজ্জুতে আঘাতপ্রাপ্ত, অটিজম, সেরিব্রাল পালসি ও স্ট্রোক রোগীদের জন্য পুনবার্সন সেবাদান কেন্দ্র, ভর্তিকৃত রোগীদের আবাসন সুবিধা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, চিকিৎসকদের জন্য আবাসন সুবিধা ও শিক্ষার্থীদের জন্য হোস্টেল সুবিধা।
মেয়র কণ্যা ডা. আনিকা ফারিহা জামান অর্ণা বক্তব্যে বলেন, আমার ভালো লাগে এই বাচ্চাগুলো এত ট্যালেন্টেড আপনারা বিশ্বাস করতে পারবেন না তাদের ছবি আঁকা দেখলে তাদের কথা শুনলে। তারা যখন কালচারাল প্রোগ্রামগুলো করে, আমি গিয়েছি দেখেছি আমার ভেতরটা কষ্টে ফেটে যায়। এই বাচ্চাগুলোর পেছনে যারা কাজ করেন তাদেরও সেই অবদান এই চিকিৎসকরাও যারা কষ্ট করে সারাদিন রাত পরিশ্রম করছে তাদের জন্য।
ডা: অর্ণা আরো বলেন, আমরা একটা সুস্থ সমাজ ও অসুস্থ সমাজ দুই ভাগে ভাগ করে দিয়েছি কেনো। কেন আমরা একটা সমাজ হতে পারছি না, সবাই একটা হতে পারছি না কেন, সবাই সুস্থ হতে পারছি না কেন, কেন মানতে পারছিনা ওরা আমাদের, আমাদেরই অংশ। আজ যদি আমার সন্তান প্রতিবন্ধী হয় আমি কি তাকে ফেলে দিব, আমি কিভাবে মা হিসেবে তাকে ফেলে দিব আমি পারবো না।
নিজের কথায় তিনি বলেন, আমি দেখেছি আমার মাকে কষ্ট পেতে,আমরা যখন অসুস্থ থাকি, আমার এই শারীরিক গঠনের কারণে মানুষ যখন বিভিন্ন কথা বলে ভাবী আপনার মেয়ে মোটা হয়ে যাচ্ছে এত খাওয়ান। আমি সত্যি বলছি বাসায় তেমন খাবার হয় না বা লুকিয়ে খাবার অভ্যাস আমার নেই। কিন্তু এখন হয়ে গেছি এরকম কি করব, ডাক্তার হিসেবে আমিও জানি এটা খারাপ। আমি চেষ্টা করিনি নিজেকে ঠিক করার আমি করবি ইনশাল্লাহ।
আমি একটা জিনিস প্রমাণ করেছি যখন আমি রাজনীতি করতে এসেছিলাম। সবাই বলেছিল মোটা মেয়ে মিছিল করতে পারবা না, একটা ককটেল পড়লে সেখান থেকে পালাতে পারবে না, কোন দুর্ঘটনা ঘটলে সেখান থেকে সরতে পারবা না। আমি প্রমাণ করেছিতো আমি পারছি। আমি আমার বয়সের তুলনায় যে জায়গায় আসার দরকার তার চেয়ে উঁচু জায়গায় এসেছি।
আমি আমার বয়সের তুলনায় যে জায়গায় আসার দরকার তার চেয়ে উঁচু জায়গায় এসেছি। আমি মনে করি এটা আমার যোগ্যতা, আমার মনে সেই ইচ্ছা ছিল আমার মাথায় সে শক্তি ছিল সেজন্য আমি পেরেছি এবং অটিস্টিক সুবিধাবঞ্চিত বঞ্চিত এসকল শিশুদের সঠিক চিকিৎসা দিলে তারাও পারবে।
রাজশাহীর এ পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে প্রতি বছর ৫ হাজার মানুষ স্ট্রোকের চিকিৎসা ও অন্যান্য শারীরিক প্রতিবন্ধকতার চিকিৎসা পাবেন। এছাড়া স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি, কৃত্রিম অঙ্গ প্রত্যঙ্গ তৈরি, ফিজিওথেরাপিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা নিতে পারবেন শিক্ষার্থীরা।
রাজশাহীতে এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পক্ষে পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্রের (সিআরপি) প্রতিষ্ঠাতা ভ্যালেরি অ্যান টেইলর বলেন, আমি অত্যন্ত আনন্দিত। আমার আনন্দ প্রকাশের ভাষা নেই। শহরের মধ্যে সড়কের পাশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ১৫ বিঘার একটি জমি পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষের কল্যানে সিআরপিকে দান করলেন মাননীয় মেয়র এ.এইচ.এম খায়রুজ্জামান লিটন ও তাঁর পরিবার। আমরা রাজশাহীতে সাভারের পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র-সিআরপি এর আদলে আরেকটি পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ে তুলবো। সেখানে প্রতি বছর এ অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ চিকিৎসা সেবা পাবেন।
টিআরপি’র চেয়ারম্যান মুহাম্মদ সাইদুর রহমান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। অনুষ্ঠানে শহীদ কামারুজ্জামান ও জাহানারা জামান পরিবারের সদস্য বিশিষ্ট সমাজসেবী শাহীন আকতার রেণী ও আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য ডা. আনিকা ফারিহা জামান অর্ণা বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে সিআরপি বিষয়ক উপস্থাপনা করেন সিআরপি‘র বিএইচপিআই এর প্রিন্সিপাল ডা. মোঃ ওমর আলী সরকার।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন টিআরপি‘র সদস্য মুশতাক আহমেদ, রাজশাহী রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি রশিদুল হাসান, আরএমপি‘র অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার বিজয় বসাক, স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক এনামুল হক, উপ-পরিচালক শাহানা আখতার জাহান প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন কবিকুঞ্জ সভাপতি প্রফেসর রুহুল আমিন প্রামাণিক, রাজশাহী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. নওশাদ আলীবঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর শামসুদ্দিন আহমেদ খোকন, রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাসুদুর রহমান রিংকু, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক এসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. এসএমএ মান্নান, সাবেক মহানগর কমাণ্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. আব্দুল মান্নান, কাটাখালি পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম, কাটাখালি পৌর সভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র আনোয়ার সাদাত নান্নু প্রমুখ।
অনুষ্ঠানটিতে সভাপতিত্ব করেন, টিআরপি’র চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইদুর রহমান। পরিচিতি সভায় উপস্থিত ছিলেন, রাজশাহী জেলা পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক আব্দুল বাতেন, রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আনিসুর রহমান, সিআরপি’র সদস্য মুশতাক আহমেদ সহ রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন পর্যায়ের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা।
আপনার মতামত লিখুন :