রাজশাহীর খাদ্য বিভাগে চলছে অনিয়ম-দুর্নীতির মহোৎসব। জেলা ও আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের ছত্রছায়ায় নিম্নমানের, দুর্গন্ধযুক্ত ও খাওয়ার অনুপযোগী চাল সরকারি গুদামে প্রবেশ করছে এবং তা বিতরণ করা হচ্ছে “খাদ্য বান্ধব কর্মসূচি”র আওতায়। দরিদ্র মানুষের জন্য বরাদ্দ এই চাল এখন দুর্নীতির পসরায় পরিণত হয়েছে। বিভাগজুড়ে লুটপাটের অঙ্ক ছুঁয়েছে অর্ধশত কোটি টাকা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের যোগসাজশে একাধিক অটো রাইস মিল থেকে নিম্নমানের সিদ্ধ চাল সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা না নিয়ে বরং সাংবাদিকদের প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়েছে। গোপনে চাল সরানোরও প্রমাণ মিলেছে। ইতোমধ্যে নিম্নমানের পচা চাল ক্রয়ের অভিযোগে ভবানীগঞ্জ খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. বাচ্চু মিয়াকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। তবে মূল সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে থাকা জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক (ডিসি ফুড) ওমর ফারুক এবং আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক (আরসি ফুড) মাইন উদ্দিন রয়ে গেছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
অভিযোগ রয়েছে, এই দুই কর্মকর্তা দীর্ঘদিন ধরে নিয়োগ বাণিজ্য, পদোন্নতি, পদায়ন ও সরকারি বরাদ্দের অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অনিয়মে জড়িত। সম্প্রতি নিজেদের সিন্ডিকেটের সদস্যদের পদায়ন দিয়েছেন আরসি ফুড মাইন উদ্দিন, যা নিয়মবহির্ভূত বলে জানা গেছে।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী, বাগমারা, পবা, মোহনপুর, দূর্গাপুর, তানোর, বাঘা, চারঘাট ও পুঠিয়া উপজেলার গুদামগুলোতে পাওয়া গেছে খুদ মিশ্রিত, অর্ধসিদ্ধ, বিবর্ণ ও দুর্গন্ধযুক্ত চালের বস্তা। সরকার নির্ধারিত আর্দ্রতা যেখানে ১৪% থাকার কথা, পরীক্ষায় সেখানে পাওয়া গেছে ১৩.৮%, তাও নিম্নমানের দানায় ভরা। ঘুষের বিনিময়ে উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তারা এসব চাল গ্রহণ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এমনকি ভুয়া লাইসেন্স ব্যবহার করে সরবরাহের ঘটনাও ধরা পড়েছে। মোহনপুরের ব্যবসায়ী আতাউর রহমান গণমাধ্যমকে স্বীকারোক্তি দিয়ে বলেন, নিজস্ব লাইসেন্স না থাকলেও অন্য মিলের নামে ৪২০ মেট্রিক টন চাল সরবরাহ করেছেন। অন্যদিকে মাহফুজুর রহমান রাইস মিল, নূরজাহান চালকল ও মোল্লা চালকল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তাদের নামে সরবরাহ দেখানো হলেও বাস্তবে তারা কোনো চাল দেয়নি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা প্রাথমিক তদন্তে নিম্নমানের চাল সরবরাহের সত্যতা পেয়েছেন। তবে এখনো দোষীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। দুর্গাপুর উপজেলায় খাওয়ার অনুপযোগী ৮০ মেট্রিক টন চাল রাতারাতি গুদাম থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।
প্রশাসনের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, জেলা ও আঞ্চলিক খাদ্য অফিসের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ধান না কিনেই সরাসরি নিম্নমানের চাল সংগ্রহ করা হয়েছে এবং ভুয়া পরিবহন ব্যয় দেখিয়ে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ওমর ফারুক সাংবাদিকদের কোনো বক্তব্য দিতে অস্বীকৃতি জানালেও অন্য এক গণমাধ্যমে বলেন, “তদন্ত চলছে, প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাবে না।”
অন্যদিকে আরসি ফুড মাইন উদ্দিনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বলেন, “খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির চাল দরিদ্র মানুষের অধিকার। নিম্নমানের চাল সরবরাহ বা দুর্নীতি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। দ্রুত তদন্ত করে দায়ীদের শাস্তি দিতে হবে।”
উল্লেখ্য, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের জেলা নওগাঁ—একই জেলার বাসিন্দা জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ওমর ফারুক। মন্ত্রীর আমলে পদোন্নতি পাওয়া এই কর্মকর্তা এখনো একই পদে বহাল রয়েছেন, যদিও তার বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি উঠেছে জোরেশোরে।
আপনার মতামত লিখুন :