সর্বশেষ :

“কাওসারের পেটে গুলি”—উত্তরার রোদ ঝলমলে বিকেলে হারিয়ে যাওয়া একটি নাম

তালিকাবিহীন এক কিশোর, এক পরিবারের লোন, আর উত্তরার রাস্তায় জুলাইয়ের প্রতিধ্বনি


অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশের সময় : সেপ্টেম্বর ৪, ২০২৫ । ১২:২৫ পূর্বাহ্ণ
তালিকাবিহীন এক কিশোর, এক পরিবারের লোন, আর উত্তরার রাস্তায় জুলাইয়ের প্রতিধ্বনি

মো. মানিক হোসেন : উত্তরা ৮ নম্বর সেক্টরের পাবলিক স্কুলের সামনেটা ছিল ১৯ জুলাইয়ের এক সাধারণ বিকেল—যতক্ষণ না হাউজবিল্ডিং রোড ধরে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া এসে পৌঁছায় স্কুলগেটের কাছে। ১১ বছরের গাজী মো: কাওসার, রেললাইনের ধারের বাসা থেকে ছুটে এসেছিল শব্দ-গন্ধ—ফাঁকা গুলির তীব্র ধোঁয়া, কাঁদানে গ্যাসের ঝাঁজ, আর “লা/শে/র উপর লা/শ”—এই কথাগুলোর টানেই। তার পরিবারের ভাষ্য, “পুলিশের চাইনিজ রাইফেলের” একটি গুলি কাওসারের পেট ভেদ করে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে বেরিয়ে যায়। এরপর সবকিছু খুব দ্রুত ঘটে—রক্ত, হুলস্থুল, অপরিচিত মানুষদের কাঁধে করে হাসপাতালের দিকে ছোটা। কিন্তু সেই কিশোরের নাম আজও কোথাও নেই—কোনো সরকারি তালিকায়, কোনো ‘শহীদের’ খতিয়ানে, কোনো ক্ষতিপূরণ ঘোষণায়ও না। এটি শুধু একটি “নামহীন” ঘটনা নয়; এটি জুলাইয়ের রাস্তায় পড়ে থাকা অনথিভুক্ত শোকের প্রতীক।

জুলাইয়ের ১৮–১৯ তারিখে উত্তরা জুড়ে যে সংঘর্ষ দানা বাঁধে, সেটি দেশের শিরোনাম কাঁপায়—কেবল ঢাকাই নয়, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও। ১৯ জুলাইয়ের দিন শেষে অন্তত ১১ জনের মৃত্যু খবর আসে উত্তরার বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে; আহতের হিসাব অগণিত—এসব তথ্য সেদিনের মাঠ-রিপোর্ট থেকে উঠে আসে। দেশের জাতীয় গণমাধ্যম সেই দিনটিকে “সারা দেশে ২৭ জন নিহত; অন্তত ১১ জন ছাত্র” বলেও চিহ্নিত করে, যেখানে উত্তরার হাসপাতালগুলোর নাম-ঠিকানা ধরে মৃত্যু-আঘাতের বয়ান আছে। কিন্তু অচেনা অনেক মুখের পরিচয় তখনও অজানা থেকে যায়।

পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে ইউনিসেফ জানায়—জুলাইয়ের আন্দোলনে অন্তত ৩২ শিশুর মৃত্যু হয়েছে; আরও অনেকে আহত ও আটক। এই পরিসংখ্যান কাওসারের মতো কিশোরদের “গণনায় না-থাকার” বেদনা আরও বাড়িয়ে দেয়।

জুলাইয়ের ঘটনাপ্রবাহে নিহতদের “তালিকা” নিয়ে একাধিক পক্ষ কাজ করেছে। রাজনৈতিক দল-সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগের খসড়া তালিকাও ঘুরেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এমনকি একটি প্রকাশ্য ওয়েবসাইটে বিভাগ-ওয়ারি নাম-ধাম লিপিবদ্ধ হয়েছে—ঢাকা শহরের বহু “শহীদ” নাম আছে সেখানে, উত্তরা-আজমপুর-ফার্মগেট—অসংখ্য লোকেশনধারী এন্ট্রি। তবু কাওসারের নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি এই তালিকায়।

জুলাই রেভ্যুলেশনারী এলায়েন্স (JRA)—আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে সহায়তা তোলার ডাক দিয়ে বেশ সক্রিয় ছিল—তাদের প্রকাশ্য পোস্টে দাবি-দাওয়ার কথা আছে, সংবাদ সম্মেলনের কথাও আছে; পরিবারের মতে, সেখান থেকেই কাওসার সামান্য আর্থিক সহায়তা পেয়েছে। কিন্তু সরকারি বা প্রশাসনিক পর্যায়ে “তালিকাভুক্তি”—এখনও অধরাই।

কাওসারের পরিবারের ভাষ্য—“পুলিশের চাইনিজ রাইফেল” থেকে ছোড়া গুলি কাওসারের পেট ভেদ করে। সাংবাদিকতার নীতিমালায়, এমন সংবেদনশীল দাবিকে আমরা স্পষ্টভাবে ‘পরিবারের দাবি’ বা ‘চোখে দেখা প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান’ হিসেবে উল্লেখ করি; এবং পাল্টা মতামত বা পুলিশের বক্তব্য নিলে তবেই “নিশ্চিত” বলি। উত্তরা-সংঘর্ষের দিন ও পরদিনের প্রতিবেদনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলি/ব্রাশফায়ারের অভিযোগ একাধিকবার উঠেছিল; উত্তরায় বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়াসহ নিহতের খবরও প্রকাশিত। তবে প্রতিটি ঘটনায় অস্ত্রের উৎস, ক্যালিবার বা সুনির্দিষ্ট ইউনিট—এসব প্রশাসনিকভাবে যাচাই না হলে নিরপেক্ষভাবে ‘অভিযোগ’ হিসেবেই লিখতে হয়।

কাওসারের বাবা বলেন, “বিভিন্ন দফতরে দৌড়েছি, কেউ শুনেনি। লোন করে চিকিৎসা চালিয়েছি, এখন কিস্তির ভাড়ও তুলতে পারছি না।” জুলাই-পরবর্তী সময়ে ঢাকা শহরের বহু পরিবার একই কথাই বলেছে—চিকিৎসা, আইনি দৌড়ঝাঁপ, আর্থিক টানাপোড়েন। গণমাধ্যমের খবর বলছে, উত্তরার হাসপাতালগুলো সেই দিন আহতদের ঢল সামলাতে হিমশিম খেয়েছিল। কারও নাম-ঠিকানা তখনও অজানা, অনেকে “অপরিচিত” হিসেবেই রয়ে গেছে রিপোর্টে। এই অনিশ্চয়তা “তালিকা” তৈরির প্রক্রিয়াকেও জটিল করেছে।

রাষ্ট্রীয় ক্ষতিপূরণ, চিকিৎসা সহায়তা, আইনি সুরক্ষা—সবকিছুর দরজা খুলতে “তালিকাভুক্তি” হলো প্রথম চাবিকাঠি। ভুক্তভোগীর নাম সরকারি নথিতে না থাকলে হাসপাতালের বিল থেকে পুনর্বাসন—সবই ব্যক্তিগত সম্পর্ক, দানের অর্থ আর এনজিও-চালিত ক্ষুদ্র সহায়তার ওপর ঝুলে থাকে। জুলাই-পরবর্তী মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে শিশু-ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি স্পষ্ট করে উঠে এসেছে; কিন্তু মাঠের বাস্তবতায় পরিবারের হাতে কাগজ-কলমে স্বীকৃতি না থাকলে দীর্ঘমেয়াদে ন্যায়বিচার ও ক্ষতিপূরণ—দুটোই ঝুলে থাকে।

১৯ জুলাইয়ের ভোর-দুপুরজুড়ে উত্তরা জুড়ে সহিংসতা, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, টায়ার জ্বালানো, কাঁদানে গ্যাস—সব মিলিয়ে রাস্তায় রাস্তায় থমথমে পরিস্থিতি ছিল। সন্ধ্যার পর হাসপাতালগুলোতে মৃত ও আহতদের ঢল নামে—কেউ শিক্ষার্থী, কেউ শ্রমজীবী, কেউ পথচারী। জাতীয় দৈনিকগুলোর প্রতিবেদনে উত্তরার ঘটনাপুঞ্জির বিশদ উঠে এসেছে; দিনশেষে সংখ্যাটা দাঁড়ায় “উত্তরাতেই ১১ জন”—যা সেদিনের সবচেয়ে বড় সংবাদ শিরোনামগুলোর একটি।

কাওসারকে নিয়ে পরিবার-স্বজনদের নির্মিত ডকুমেন্টারি ফুটেজ আছে—সেই বিকেলের বিশৃঙ্খলা, হাসপাতালের ভেতরের ভিজ্যুয়াল, ব্যথায় কুঁকড়ে থাকা শিশু—সবই নাকি ফুটে উঠেছে সেখানে। কিন্তু ভিডিও প্রমাণ যতই বেদনা-জাগানিয়া হোক, প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় ‘তথ্য-প্রমাণ’ মানদণ্ড আলাদা: এন্ট্রি নম্বর, জিডি/কেস নম্বর, ফরেনসিক বা মেডিকো-লিগ্যাল ডকুমেন্ট, হাসপাতালের অ্যাডমিশন-ডিসচার্জ স্লিপ, এবং প্রত্যক্ষদর্শীর লিখিত জবানবন্দি। এই কাগজগুলো ছাড়া “তালিকাভুক্তি” অনিশ্চিত রয়ে যায়—এটাই মাঠের বাস্তবতা।

পুরোনো সংখ্যা

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০  
%d bloggers like this: