মো. মানিক হোসেন : চার দফা যৌক্তিক দাবি আদায়ের লক্ষ্যে রাজশাহী নগরীতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন ওষুধ ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ কেমিস্টস অ্যান্ড ড্রাগিস্টস সমিতি (বিসিডিএস)-এর কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার (২২ মে) সকাল ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত নগরীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট লক্ষীপুর মোড়ে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
এই সময়ের মধ্যে শহরের প্রায় সব ওষুধের দোকান বন্ধ রাখা হয়, যার ফলে তাৎক্ষণিকভাবে সাধারণ জনগণ, বিশেষ করে রোগীর স্বজনরা কিছুটা বিপাকে পড়েন। তবে ব্যবসায়ীদের দাবি, এই সাময়িক ভোগান্তির পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের উপেক্ষিত সমস্যার সমাধানের আর্তি।
ওষুধ ব্যবসায়ীদের উত্থাপিত চার দফা দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে— ওষুধ বিক্রয়ের কমিশন বৃদ্ধি করা,
মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ দ্রুত ফেরত নেওয়া ও প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, ড্রাগ লাইসেন্সবিহীন ফার্মেসিতে ওষুধ সরবরাহ বন্ধ করা, সকল ওষুধের দাম সরকার নির্ধারণ করে দেয়ার বাধ্যবাধকতা প্রবর্তন করা।
এই দাবিগুলো তারা ব্যানার, ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ডে তুলে ধরেন এবং গণমাধ্যমের সামনে স্পষ্ট করেন, এসব দাবি বাস্তবায়ন না হলে ওষুধ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বেন।
মানববন্ধনে উপস্থিত বাংলাদেশ কেমিস্টস অ্যান্ড ড্রাগিস্টস সমিতির রাজশাহী মহানগর শাখার সভাপতি মোহাম্মদ হারুনুর রশিদ বলেন, “আমরা ওষুধ ব্যবসায়ী— জনস্বার্থে কাজ করি। অথচ দিনের পর দিন আমাদের লাভের হার কমছে, কোম্পানিগুলো নিজেদের সুবিধামতো কমিশন কমিয়ে দিচ্ছে, অথচ খরচ বাড়ছে প্রতিনিয়ত।”
তিনি আরও বলেন, “একটা সময় ছিল যখন ওষুধ বিক্রয়ে ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন পাওয়া যেত, এখন অনেক কোম্পানি সেটা ৫-৭ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। এতে ছোট ব্যবসায়ীরা টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে।”
ওষুধের মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়া একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলেও এসব ওষুধ ফেরত না নেওয়া কোম্পানিগুলোর একটি সাধারণ অভ্যাসে পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের।
সহ-সভাপতি রফিকুল ইসলাম শামীম বলেন, “বাজারে প্রতিদিন নতুন ওষুধ আসছে। অথচ পুরোনো ওষুধ বিক্রি না হলে তা মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়ে, কোম্পানিগুলো সে ওষুধ ফেরত নেয় না। এতে দোকানদার অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়েন এবং কখনও অনিচ্ছাকৃতভাবে সে ওষুধ বিক্রিও হয়ে যেতে পারে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি।”
একটি বড় ধরনের উদ্বেগ হিসেবে ব্যবসায়ীরা তুলে ধরেন লাইসেন্সবিহীন ফার্মেসিতে ওষুধ সরবরাহের বিষয়টি।
নির্বাহী সদস্য সেলিম পারভেজ বলেন, “নগরীর বিভিন্ন স্থানে, এমনকি গ্রামাঞ্চলে বহু ফার্মেসি আছে যাদের কোনো ড্রাগ লাইসেন্স নেই। অথচ বড় কোম্পানির প্রতিনিধিরা সেখানে নির্বিঘ্নে ওষুধ সরবরাহ করছেন। এটা আইনগতভাবে যেমন বেআইনি, তেমনি বৈধ ব্যবসায়ীদের জন্য চরম বৈষম্যের উদাহরণ।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা চাই, ওষুধ বিক্রয়ের আগে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট দোকানের লাইসেন্স যাচাই করা হোক, নয়তো বাজারে অনিয়ন্ত্রিত ও অবৈধ বিক্রয় বাড়বে।”
চতুর্থ দাবি হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলেছেন, সব ওষুধের দাম সরকার নির্ধারণ করুক। এতে ভোক্তা যেমন সুবিধা পাবে, তেমনি বাজারে এক ধরনের স্থিতিশীলতা আসবে।
বক্তব্যে শহিদুল্লাহ খান ডন বলেন, “একই ওষুধের দাম এক কোম্পানি নিচ্ছে ১০ টাকা, আরেকটা নিচ্ছে ২৫ টাকা। এটা কেমন বিচার? সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়, দোকানদাররা হয় ভুক্তভোগী। সরকার যদি নির্ধারিত মূল্যে বিক্রির বাধ্যবাধকতা দেয়, তাহলে সবার জন্য সুবিধা হয়।”
বিসিডিএস নেতারা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, এই দাবিগুলো বাস্তবায়নে যদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে দেশব্যাপী ফার্মেসি বন্ধ রেখে লাগাতার আন্দোলনের দিকে যেতে বাধ্য হবেন তারা।
রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলা থেকে আগত ব্যবসায়ীরাও মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করেন। উপস্থিত ছিলেন মারুফ আহমেদ তারেক, সাদেকুল ইসলাম অপু, শাহীন আলম, মিজানুর রহমানসহ অন্তত অর্ধশতাধিক ওষুধ ব্যবসায়ী নেতা।
তারা একমত হয়ে বলেন, এই আন্দোলন কোনো ব্যক্তি বা দলের স্বার্থে নয়, বরং এটি দেশের ওষুধ ব্যবসায়ীদের সার্বিক টিকে থাকার আন্দোলন।
মানববন্ধন শেষে একটি প্রতিনিধি দল রাজশাহী জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করে। এতে তারা দ্রুত সময়ের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যাগুলোর সমাধান চেয়ে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদানের অনুরোধ জানান।
অবশ্য মানববন্ধন চলাকালীন সময় ফার্মেসি বন্ধ থাকার কারণে ওষুধ কিনতে এসে অনেকেই ভোগান্তির শিকার হন। রোগীর স্বজন জাহানারা বেগম বলেন, “হাসপাতাল থেকে বের হয়ে ইনজেকশন আনতে এসেছিলাম, কিন্তু দোকান বন্ধ। আশপাশ ঘুরে কোথাও পেলাম না।”
তবে ব্যবসায়ীরা বিষয়টি অনাকাঙ্ক্ষিত বলেই স্বীকার করেন এবং ভবিষ্যতে এমন কর্মসূচি চলাকালীন জরুরি ওষুধের দোকান খোলা রাখার বিষয়েও ভাবনার কথা জানান।
রাজশাহীতে ওষুধ ব্যবসায়ীদের এই মানববন্ধন শুধু স্থানীয় কোনো আন্দোলন নয়, এটি দেশের ওষুধ খাতের একটি বৃহত্তর সংকটের প্রতিফলন। দাবি বাস্তবায়ন না হলে সামনে আরও কঠোর কর্মসূচির ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন ব্যবসায়ীরা। এখন দেখার বিষয়— সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এই সংকট সমাধানে কতটা আন্তরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
আপনার মতামত লিখুন :