এসএনএ ডেস্ক : পদ্মা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ জমা হচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। সর্বশেষ, ১৪ এপ্রিল দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে নাফিজ সরাফাত, আব্দুল মোনেম লিমিটেডের দুই শীর্ষ কর্মকর্তা এবং পদ্মা ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
দুদকের অভিযোগপত্র অনুযায়ী, আসামিরা পরস্পরের যোগসাজশে পদ্মা ব্যাংকের গুলশান কর্পোরেট শাখা থেকে ৫ কোটি টাকার ঋণ গ্রহণ করেন, যা ছিল ৬ মাস মেয়াদি। কিন্তু এই ঋণ ব্যবসার চলতি মূলধনের কাজে না লাগিয়ে পুরনো ঋণ পরিশোধে ব্যবহার করা হয়—এটি ছিল সুস্পষ্ট শর্ত ভঙ্গ ও ক্ষমতার অপব্যবহার।
আসামিদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলায় অভিযোগ আনা হয়েছে দণ্ডবিধির ৪০৯, ১০৯, ৪২০ ও ৫১১ ধারায়, তৎসহ দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ৫ (২) ধারায়। এটি শুধু একটি নির্দিষ্ট লেনদেন নয়—বরং একটি বড় দুর্নীতির চক্রের চিত্র তুলে ধরছে।
২০১৭ সালে যখন নাফিজ সরাফাত পদ্মা ব্যাংকের (তৎকালীন ফারমার্স ব্যাংক) চেয়ারম্যান হন, তখন থেকেই ব্যাংকের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় একের পর এক অনিয়ম শুরু হয়। অভিযোগ আছে, তিনি ঘুষ, স্বজনপ্রীতি, ভুয়া প্রতিষ্ঠানকে ঋণ অনুমোদন এবং অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে একপ্রকার নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন পুরো ব্যাংক ব্যবস্থাপনাকে।
দুদকের তদন্ত বলছে, তার প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় গ্রাম-বাংলা ফার্টিলাইজার নামক একটি প্রতিষ্ঠানে ৪০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়, যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা ছিল। একইভাবে, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে জেসিকা ইন্টারন্যাশনালের অনুকূলে ৬০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করা হয়, যার টাকাও আত্মসাৎ করা হয়েছে।
শুধু একটি দুটি নয়—তদন্তে দেখা যায়, নাফিজ সরাফাত ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে পদ্মা ব্যাংক থেকে মোট ৫০০ কোটি টাকারও বেশি অর্থ সরিয়েছেন। এসব অর্থ কখনো পদ্মা সিকিউরিটিজের মাধ্যমে স্ট্র্যাটেজিক ফাইন্যান্সিয়াল গ্রুপে, আবার কখনো ব্যক্তিগত কোম্পানির নামে, এমনকি তার স্ত্রীর পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টেও জমা হয়েছে।
দুদকের তথ্য অনুসারে, ‘ফ্লোরা সফটওয়্যার লিমিটেড’ নামে একটি কোম্পানি থেকে ব্যাংকের জন্য সফটওয়্যার কেনার নাম করে ৮ কোটি টাকা ঘুষ নেওয়া হয়। ওই কোম্পানির মালিকের চেক ব্যবহার করে একদিনেই ৫ কোটি টাকা ভাঙিয়ে ব্যাংকের ভল্ট থেকে তুলে নেওয়ার ঘটনাও তদন্তে উঠে এসেছে।
দেশ থেকে হাতিয়ে নেওয়া বিপুল পরিমাণ অর্থের একটি বড় অংশ পাচার করা হয় বিদেশে। তদন্তে উঠে এসেছে, কানাডায় একটি বিলাসবহুল বাড়ি, একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং বিনিয়োগ করেছেন নাফিজ সরাফাত। তার নামে বা স্ত্রীর নামে কানাডার ভ্যাঙ্কুভার এবং টরন্টোতে একাধিক সম্পদের অস্তিত্ব মিলেছে।
অন্যদিকে, তার এ অপকর্মের খেসারত দিচ্ছে পদ্মা ব্যাংক। এই ব্যাংক ইতোমধ্যেই দ্বিতীয় দফা বড় আর্থিক সংকটে পড়েছে। আমানতকারীরা আস্থা হারাচ্ছেন, ব্যাংকের শেয়ারের মূল্যপতন ঘটেছে, এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক একাধিকবার মনিটরিং জারি করেছে।
নাফিজ সরাফাত কেবল ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় নয়, শেয়ারবাজারেও দুর্নীতির বিস্তৃতি ঘটান। পদ্মা ব্যাংকের অঙ্গ-প্রতিষ্ঠান পদ্মা সিকিউরিটিজকে ব্যবহার করে প্রায় ২০০ কোটি টাকা শেয়ারবাজার থেকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এমনকি, সাউথইস্ট ব্যাংকের শেয়ার কিনে সেখানে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টাও করেন।
জানা গেছে, ওই ব্যাংকের পরিচালক পদে তিনি নিজের স্ত্রী, এক সহযোগী ও আত্মীয়কে বসান। পরিকল্পনা ছিল তাকে চেয়ারম্যান বানানোর, তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি ও কয়েকটি গণমাধ্যমে রিপোর্ট প্রকাশের পর সেই প্রচেষ্টা থেমে যায়।
বর্তমানে নাফিজ সরাফাত পলাতক বা দেশের বাইরে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। ২০২৪ সালের ৩১ জানুয়ারি, ব্যক্তিগত ও স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে তিনি পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করেন। যদিও ততদিনে দুদকসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে দেয়।
তবে এখানেই প্রশ্ন উঠছে—ব্যাংকিং খাতে এমন বিপর্যয় ঘটিয়েও কেন এতদিন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে ছিলেন তিনি? একের পর এক অর্থ আত্মসাতের ঘটনা সত্ত্বেও কেন যথাসময়ে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি?
অর্থ আত্মসাত, মানি লন্ডারিং, দুর্নীতির এই ভয়াবহ চিত্র বহু আগেই মিডিয়ায় আসলেও, প্রশাসনের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কোনো কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। অর্থনীতিবিদ ও দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাগুলোর মতে, ব্যাংকিং খাতের প্রতি সরকারের মনোযোগ ও কঠোরতা না থাকলে এমন ঘটনা ভবিষ্যতেও চলতে থাকবে।
নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত একটি বড় আর্থিক প্রতারণার চিত্র তুলে ধরেছে। শুধু একজন ব্যক্তি নন, একটি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির চক্রের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। ৫০০ কোটির বেশি টাকা আত্মসাতের মাধ্যমে একটি ব্যাংককে দুর্বল করে তোলার পাশাপাশি সাধারণ জনগণের আমানতের নিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলেছেন।
এখন প্রশ্ন হলো—এই অর্থ পুনরুদ্ধার কি সম্ভব? আর নাফিজ সরাফাত কি আদৌ দেশে ফিরে আইনের মুখোমুখি হবেন? না কি তিনি সেই তালিকার আরেক সদস্য হবেন, যারা দুর্নীতির পাহাড় গড়েও থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে?
আপনার মতামত লিখুন :